সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১০ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
“এক সময় যে নদীগুলোতে জাহাজে করে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কলকাতা যাওয়া যেতো, নদীতে এত ¯্রােত ছিল, যার কারণে এই নদী পথে নৌকা নিয়ে আসা-যাওয়া করতে ভয় হত। সারা বছরই লঞ্চ ও কার্গো চলাচল করত। কিন্তু এখন ১৫-১৬ বছর ধরে ¯্রােতহীন নদীতে পানিই থাকে না। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পরই নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নদী ভরাট হয়ে মাঠে পরিণত হয়েছে। মাঘ-ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে নদীর তলদেশে গরু ঘাস খায় ও গ্রামের শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করে। হেমন্তে পানি সংকটের কারণে জমিতে চাষাবাদে সমস্যা হয়। অপরদিকে ভরা বর্ষায় নদীর পানি বাড়ি-ঘরে উঠে, ফসলের ক্ষতি করে। নদী ভরাটের ফলে বর্ষা-হেমন্তে দুই সময়েই সমস্যা হচ্ছে”। এভাবেই পুরাতন সুরমা নদী ভরাটের কুফল জানাচ্ছিলেন নদীর দুই তীরের স্থায়ী বাসিন্দারা।
সরেজমিনে পুরাতন সুরমা নদী ঘুরে দেখা যায়, রূপ-যৌবন হারানো এই নদী দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়নপুর গ্রাম থেকে পাথারিয়া-শরিফপুর পর্যন্ত অংশ ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সামান্য পানি জমে রয়েছে। নদীর এই ১০-১২ কিলোমিটার অংশের অধিকাংশ শুকনো। ভরাট হওয়া নদীর তলদেশে গরু-ছাগল চড়ছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়নপুর, গাগলী, বোগলাকাড়া, দেবগ্রাম, নোয়াখালী, জামলাবাজ, হাসনাবাজ, হাসারচর, নগর, আন্দাবাজ, গণিগঞ্জ, কান্দিগাঁও, পাথারিয়া-শরিফপুর পর্যন্ত নদী ভরাটের ফলে এসব গ্রামের লোকজন চরম পানি সংকটে ভোগছেন।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ এলাকার মত না হলেও দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরি উপজেলার কৃষ্ণপুর পর্যন্ত নদীর অনেক জায়গায় পলি পড়ে ভরাট হয়েছে। পলি ভরাটে নদীর নাব্যতা সংকট হওয়ায় পুরাতন সুরমায় ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসেই নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। তবে এই অংশের ৪০ কিলোমিটার নদী খনন কাজ চলমান রয়েছে। দিরাই অংশের টানাখালী বাজারের উজান-ভাটি এলাকায় কিছু অংশে পানি থাকায় স্থানীয়ভাবে নৌ চলাচল করে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পৈন্দা থেকে শুরু হয়ে মরা সুরমা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুরে মিশেছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য ১১৬ কিলোমিটার। তবে নদীর প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার জায়গা ভরাট হয়েছে।
নদী ভরাটের ফলে কৃষি কাজসহ সব ধরণের গৃহস্থালী কাজেই চরম ব্যাঘাত ঘটছে। নদীর দুই তীরের কৃষকরা জমি চাষাবাদে চাহিদামত পানি পাচ্ছেন না। কোনো কোনো গ্রামের কৃষকরা গবাদিপশুকে পর্যন্ত পুকুর ও টিউবওয়েলের পানি খাওয়াচ্ছেন।
নদী ভরাটের ফলে নদী তীরের লোকজন উভয় সংকটে পড়েছেন। শুকনো মওসুমে যেমন পানি সংকটে ভোগেন, ঠিক তেমনি বর্ষাকালে ভরাটকৃত নদীর দুইকুল উপচে পানি বসতবাড়ি ও ফসলী জমির ক্ষতি করে। পানি সংকটের পাশাপাশি আশপাশের সকল গ্রামের লোকজন নদীর মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুকনো মওসুমে বসতবাড়িসহ অবকাঠামো নির্মাণে বালি-পাথর, বাঁশ-কাঠ পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। নদী পথে কম খরচে বেশি মালামাল পরিবহনের সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে সবাই সড়ক পথে মালামাল পরিবহন করছেন। এতে পরিবহন ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার গাগলী গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী হাজী আব্দুল গাফফার (৬২) বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক ¯্রােত ছিল এই নদীতে। ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রচলনের আগে মানুষ এই নদী দিয়ে যাতায়াত করতে ভয় পেত। তখন নদীতে অনেক পানি ছিল, হেমন্তকালেও অন্তত ২০-৩০ হাত পানি থাকত। ১৫-২০ বছর ধরে আস্তে আস্তে নদী ভরাট হয়ে এখন খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এই নদীর শাখা নদী কালনী ও কুশিয়ারা নদীর সংযোগস্থ মার্কুলি এলাকায় স্থায়ী বাঁধ ও নদীর কাঠইর থেকে নারায়নপুর বাঁক কেটে সোজা করার পর আমাদের এই অংশ দ্রুত ভরাট হয়েছে। নদী দ্রুত খনন না করলে এই এলাকায় বসবাস করা কষ্টকর হবে’।
একই গ্রামের বাসিন্দা বানেছা বেগম (৫০) বলেন, ‘অনেক বছর ধরে নদীতে পানি থাকে না। পানির জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। নদী ভরাট হয়ে জমিনের সমান হয়েছে, গরু-বাছুর ঘাস খায়। বিকেল বেলায় গ্রামের ছেলেরা বল খেলে’।
ভরাট হওয়া নদী প্রসঙ্গে গাগলী গ্রামের কৃষক মাসুক মিয়া বললেন, ‘পুরাতন সুরমা নদী ভরাটের কারণে আমরা উভয় সংকটে আছি। শুকনো-বর্ষায় দুই সময়েই আমাদের বিপদ। হেমন্তে নদীতে পানি না থাকায় জমিতে পানি দেয়া যায় না, আবার বর্ষাকালে নদীর পানি একটু বাড়লেই দুই তীর উপচে ঘর-বাড়ি ও জমিতে পানি উঠে’।
দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের তারাপাশা গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট লেখক মাওলানা আব্দুর রশিদ তারাপাশি বলেন, ‘এক সময় চৈত্রমাসেও যে নদীতে সাঁতার কেটে পার হতে হতো, কালের আবর্তে আজ সেটা একটা রুপোলি ফিতা মাত্র’।
নোয়াখালী বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘গ্রামের বয়স্করা আমাদের বলেন, আগে ভৈরব থেকে সারা বছরই নদী পথে কম খরচে সবধরণের মালামাল আনতেন ব্যবসায়ীরা। এখন নদীতে পানিই থাকে না, নৌকা চলবে কী করে’।
দিরাইয়ের চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য ললোয়ারচার গ্রামের আলী আমজদ তালুকদার বলেন, ‘রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকেই নদী ভরাট হওয়া শুরু হয়েছে। চরনারচর বাজার থেকে খালিয়াজুরির কৃষ্ণপুর গ্রাম পর্যন্ত নদী কম-বেশি পলি ভরাট হয়েছে। গত ২০-২৫ বছরেই বেশি ভরাট হয়েছে। ভাটি থেকে খনন করে উজানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড’।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর (পরিচালনা ও রক্ষাণাবেক্ষণ)-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার বলেন, ‘পুরাতন সুরমা নদী সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুরে গিয়ে মিশেছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য ১১৬ কিলোমিটার। পলি পড়ে নদীর অনেক জায়গা ভরাট হয়েছে। দিরাই-শাল্লা উপজেলায় ৪০ কিলোমিটার খনন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৮ কিলোমিটার খনন কাজ শেষ হয়েছে, খনন কাজ চলমান রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নদীর ভাটি থেকেই খনন শুরু করতে হয়, তাই দিরাই-শাল্লায় খনন করা হয়েছে। উজানে আরও ৩১ কিলোমিটার খনন করার জন্য ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি উজানের অংশটুকু খনন করা হবে। নদীর নাব্যতা রক্ষায় পরে নিয়মিত খনন করা হবে’।